আকাবিরে দেওবন্দ কেমন ছিলেন?

আকাবিরে দেওবন্দ কেমন ছিলেন?

 

দিশেহারা ছিনতাইকারী

মাওলানা ইয়াকুব রহ. হিজরত করেছিলেন। চলে গিয়েছিলেন মক্কায়। মক্কার এক গলিতে বাস করতেন তিনি। তার একটি আজীব অভ্যাস ছিল। যা সাধারণত অন্যদের মাঝে দেখা যায় না। তার অভ্যাস ছিল, টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি যা-ই আসত, তা-ই তিনি একটি থলির মধ্যে রাখতেন। থলিটি সর্বদা কাছেই থাকত। কখনোই উহাকে হাতছাড়া করতেন না। যেখানেই যেতেন সেখানেই উহাকে নিয়ে যেতেন। সঙ্গে রাখতেন সবসময়। যেন থলি আর তিনি এক অভিন্ন সত্তা। যা তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকত ওতপ্রোতভাবে।
প্রিয় পাঠক! কেন তিনি এমনটি করতেন? তবে কি তিনি টাকা-পয়সাকে বেশি ভালবাসতেন বলেই এমনটি করতেন? সঙ্গে রাখতেন সবসময়? না, টাকা-পয়সার ভালবাসা তাকে এমনটি করতে উদ্বুদ্ধ করে নি। বরং তিনি যে টাকা-পয়সাকে ভালবাসতেন না, তুচ্ছজ্ঞান করতেন সর্বদা, উল্লেখিত আচরণটি এ কথারই প্রমাণ বহন করে। কেননা বাস্তবে দেখা যায়, যারা অর্থকড়ি ভালবাসে, সম্পদের প্রতি যাদের মোহ আছে, এক কথায় যারা দুনিয়াদার, তারা টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে, গোপনে লুকিয়ে রাখে, মাটিতে পুঁতে রাখে, তালাবদ্ধ করে রাখে সিন্দুকের ভিতর, এই ভয়ে যে, না জানি কোন্ সময় তা হাতছাড়া হয়ে যায়। না জানি কোন্ সময় চোর-ডাকাতরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ফলে সম্পদ কমে যাবে, নিঃস্ব হয়ে যাব আমি। অথচ এই বুযুর্গ, এই আল্লাহর ওলী কোনটাই করতেন না। টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি, না ব্যাংকে রাখতেন, না গোপনে লুকিয়ে রাখতেন। সম্পদের প্রতি তার মোহ ছিল না বলেই উহাকে হেফাজতের জন্য তিনি কোনো চিন্তা করতেন না।
মুহতারাম পাঠক! অর্থসম্পদের প্রতি তিনি কতটা নির্মোহ ছিলেন, কতটা লোভহীন ছিলেন নিন্মোক্ত ঘটনাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আসুন আমরা ধৈর্য সহকারে ঘটনাটি শুনি।
একদিন তিনি বাজারে গেলেন। প্রয়োজনীয় একটি জিনিস কিনলেন। চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী টাকার ব্যাগ হাতেই ছিল। তিনি মূল্য পরিশোধের জন্য গোটা ব্যাগটি উপুড় করলেন। তারপর দোকানদারের পাওনা তাকে বুঝিয়ে দিয়ে বাকি টাকা পুনরায় ব্যাগের ভেতর রেখে দিলেন।
ব্যাগ উপুড় করার সময় সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন লোক। তাদের মধ্যে একজন ছিল ছিনতাইকারী। সে এ দৃশ্য দেখে লোভ সামলাতে পারল না। মনে মনে বলল, যে করেই হোক, এ টাকা আমি ছিনতাই করবই। এতগুলো টাকা নিতে পারলে কয়েকদিন রাজার হালেই দিন কাটাতে পারব।
হুজুরের পিছু নেয় ছিনতাইকারী। হুজুর বাজার থেকে বের হন। হাঁটতে হাঁটতে একটি নির্জন গলিতে প্রবেশ করেন। তখন সুযোগ বুঝে ঐ ছিনতাইকারী হুজুরের হাত থেকে ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়। তারপর দ্রত দৌড়িয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।
ব্যাগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় হুজুর একটুও বিচলিত হলেন না। চিৎকার করলেন না। কাউকে ডাকলেন না। ছিনতাইকারীর পিছে ধাওয়া করলেন না। এমন কি কারো কাছে বললেন না যে, আমার ব্যাগটি ছিনতাই হয়ে গেছে। তাকে পাকড়াও করুন। বরং তিনি পূর্বের মতোই হাঁটতে হাঁটতে বাসায় চলে এলেন।
এদিকে লোকটি পড়ল মহাবিপদে। সে টাকার ব্যাগ নিয়ে দ্রত পালাতে চাইল। বের হতে চাইল গলিপথ থেকে। কিন্তু একি! যেদিকে যায় সেদিকেই পথ বন্ধ। কিছুতেই সে বের হওয়ার পথ পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে গেল সে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ভাবতে লাগল, ব্যাপারটা আসলে কী!
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর সে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, হুজুর নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলী হবেন। কামেল লোক হবেন। এ জন্যেই আমি তাঁর টাকা ছিনতাই করে পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সুতরাং নিজের মঙ্গল চাইলে এখনই আমাকে হুজুরের বাসায় গিয়ে তার টাকার থলে ফেরত দিয়ে আসা উচিত। নচেৎ আমার আর রা নেই। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই জীবন চলে যাবে।
লোকটি হুজুরের বাসায় গেল। দরজার সামনে দাঁড়াল। আওয়াজ করে বলল, জনাব! আপনি এসে আপনার থলে নিয়ে যান। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনার সাথে আর কখনোই এমন করব না। আমি আপনার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মেহেরবানি করে আমার উপর একটু দয়া করুন। এভাবে পরপর কয়েকবার সে বলল। কিন্তু ভিতর থেকে কেউ বের হলো না। কোনো জবাবও পেল না সে।
কয়েকবার ডাকার পরও যখন কোনো উত্তর পাওয়া গেল না, তখন সে বলল, হুজুর! থলে না নিলে কমপে দাবিটা ছেড়ে দিন। তাতেও আমি বের হওয়ার একটা রাস্তা পাব বলে আশা করি। কিন্তু না, এবারও কোনো াআওয়াজ পাওয়া গেল না। তার কথার জবাব দিল না কেউ। এমতাবস্থায় সে ভাবল, চুপ থাকা সম্মতির লণ। মনে হয়ে হুজুর দাবি ছেড়ে দিয়েছেন। মাফ করে দিয়েছেন আমাকে। একথা ভেবে থলে নিয়ে আবারও সে রওয়ানা দেয়। কিন্তু এবারও আগের মতোই অবস্থা। বের হওয়ার সকল পথই বন্ধ। প্রতিটি গলির মাথায় কে যেন দেয়াল খাড়া করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। বন্ধ করে দিয়েছে লোক চলাচলের রাস্তা।
বেচারা এবার আরও পেরেশান হলো। গোটা দেহ ঘেমে ওঠল। কিছুণ নিমগ্ন রইল গভীর ভাবনায়। হঠাৎ তার মাথায় একটি দারুণ বুদ্ধি এল। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিটা প্রয়োগ করল। কাজও হলো আশানুরূপ।
সে পাশের একটি উচুঁ স্থানে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলতে লাগল, ওহে মহল্লাবাসীরা! তোমরা কে কোথায় আছ দৌড়ে এসো। আমাকে বাচাঁও। রা করো। আমার সব লুট হয়ে গেছে। আমার উপর জুলুম করেছে। অত্যাচার চালিয়েছে।
একজন অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ শুনে মহল্লাবাসীরা বেরিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার? কে তোমার উপর জুলুম করেছে? দেখিয়ে দাও তাকে। জনমের মতো শিক্ষা দিয়ে দেই। সে বলল, ঐ তো। ঐ ঘরে যিনি বসবাস করেন তিনিই আমার উপর জুলুম করেছেন।
তার কথা শুনে মহল্লাবাসীদের বিস্ময়ের অবধি রইল না। সবাই নির্বাক, নিস্তব্ধ। কারণ তারা জানে যে, এ ঘরে যিনি বসবাস করেন তিনি একজন খাঁটি মানুষ। আল্লাহর ওলী। তিনি তো কারো উপর জুলুম করবেন দূরের কথা, আজ পর্যন্ত তার দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়েছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। তিনি একজন মঙ্গলকামী মানুষ। সবসময় মানুষের উপকার করারই চেষ্টা করেন। দোয়া করেন হৃদয় খুলে।
মহল্লাবাসীরা লোকটির কথা বিশ্বাস করল না। তাদের মধ্য থেকে তবু কেউ কেউ কৌতুহলবশতঃ বলে ওঠল, চলুন আমরা ব্যাপারটি নিয়ে হুজুরের সাথে সরাসরি আলোচনা করি। তবেই আসল ঘটনা জানা যাবে।
উপস্থিত লোকজন তাদের কথা সমর্থন করল। বলল, হ্যাঁ তাই হোক।
কিছুণ পর মহল্লাবাসীদের বিনীত অনুরোধে হুজুর বেরিয়ে এলেন। বের হওয়ামাত্র হুজুরের হাত ধরে ছিনতাইকারী বলতে লাগল। এই যে, ইনিই তো আমার উপর জুলুম করেছেন। লোকজন বলল, হুজুর! আসুল ঘটনা কি মেহেরবানী করে একটু খুলে বলুন তো। আমাদের কাছে ব্যাপারটি বড়ই রহস্যময় মনে হচ্ছে। হুজুর বললেন, তাকেই জিজ্ঞেস করুন।
ছিনতাইকারীকে পুনরায় জিজ্ঞেস করতে হলো না। সে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, দেখুন, আমি এখন আপনাদের কাছে কোনোকিছুই গোপন করব না। আসল কথা হলো, আমি হুজুরের টাকার ব্যাগ ছিনতাই করে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শত চেষ্টা করেও বের হওয়ার কোনো পথ পেলাম না। তাই উপায়ান্তর না দেখে তাঁর ব্যাগ তাঁর কাছে ফেরত দিতে এসেছিলাম। কিন্তু হুজুরকে বারবার ডাকার পরও তিনি ঘর থেকে বের হলেন না। অবশেষে ব্যাগের দাবী ছেড়ে দেওয়ার জন্য বললাম। কিন্তু তাতেও কোনো সাড়া পেলাম না। তখন মনে মনে ভাবলাম, হুজুর বোধ হয়, ব্যাগের দাবী ছেড়ে দিয়েছেন। তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আগের মতোই অবস্থা হলো। বের হওয়ার পথ খুঁজে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত হুজুরকে ঘর থেকে বের করার কৌশল হিসেবে আমি এসব কাণ্ড ঘটালাম। আসলে হুজুর আমার উপর কোনো জুলুম করেননি। বরং আমিই হুজুরের ব্যাগ ছিনতাই করে তার উপর জুলুম করেছি।
এ পর্যন্ত বলে সে একটু থামল। তারপর হুজুরের দিকে ব্যাগটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, হুজুর! এই নিন আপনার ব্যাগ। এটি গ্রহণ করে আমার উপর একটু রহম করুন।
ছিনতাইকারীর কথায় হযরত ইয়াকুব রহ.একটু মুচকি হাসলেন। বললেন, এ তো আমার নয়। তোমার। তুমিই বলো, তোমার ব্যাগ আমি নেই কী করে!
এবার রাজ্যের বিস্ময় ঝরে পড়ে লোকদের চোখে মুখে। তারা অবাক হয়। অবাক হওয়ারই কথা! কারণ একজন লোক টাকাভর্তি একটি থলে এগিয়ে দিয়ে বলছে, এটি আপনার। গ্রহণ করে আমাকে দায়মুক্ত করুন। অথচ তিনি কিনা বলছেন- এ আমার নয়। এ তো দেখছি এক অদ্ভুত মামলা!
অগত্যা একজন লোক বলল, হুজুর! এ তো আপনারই। আপনি অস্বীকার করছেন কেন? এ ধরনের একটি ব্যাগতো আপনার হাতে সবসময় আমরা দেখে আসছি।
জবাবে মাওলানা ইয়াকুব রহ. বললেন- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। এ ব্যাগ আমারই ছিল। তবে এখন আর আমার নেই। কারণ ব্যাগাটি ছিনতাই হওয়ার সাথে সাথে আমার এ খেয়াল হলো যে, ছিনতাই করা হারাম। লোকটি তো হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার দরুণ গোনাহগার হয়ে গেল এবং এ গোনাহের কারণে তাকে হয়তো জাহান্নামেও যাওয়া লাগতে পারে। এ ব্যাপারটি আমার মনে দারুণ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। মনে মনে ভাবি, আমার কারণে একটি লোক দোজখের জ্বলন্ত আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হবে, সীমাহীন কষ্টে নিপতিত হবে তা তা কী করে হয়? তাই সঙ্গে সঙ্গে আমি ব্যাগসহ সম্পূর্ণ টাকা তাকে দান করে দিয়েছি। সেই সাথে মাও করে দিয়েছি অন্তর থেকে। আর শরীয়তের বিধান হলো, কোনো কিছু দান করার পর তা ফেরত নেওয়া জায়েয নেই। সুতরাং সে-ই এখন এ সম্পদের মালিক। এখন আপনারাই বলুন, এ টাকা আমি কীভাবে ফেরত নেই?
প্রিয় পাঠক! দেখলেন তো, মানুষের প্রতি হযরত ইয়াকুব সাহেব রহ.এর কি পরিমাণ দরদ ছিল। কতটা গভীরে গিয়ে চিন্তা করতেন তিনি। একজন ছিনতাইকারী তার কারণে কষ্ট পাবে, এজন্য তিনি পুরো টাকাই তাকে দান করে দিলেন। দয়া ও মহানুভবতার সুন্দর দৃষ্টান্ত এর চেয়ে আর কী হতে পারে?
এখানে একটি মাসআলা জেনে নেওয়া প্রয়োজন যে, যদিও হযরত ইয়াকুব রহ. সব টাকা ছিনতাইকারীকে দান করে দিয়েছেন, তথাপি এ অবস্থায় তা ফেরত নেওয়া জায়েজ ছিল। কেননা, এখানে শুধু ঈজাব (প্রস্তাব) পাওয়া গিয়েছে, কবুল (গ্রহণ) পাওয়া যায়নি। আর শুধু ঈজাব দ্বারা হেবা তথা দান পূর্ণ হয় না। তাছাড়া যাকে দান করা হলো সে নিজেই খুশি মনে তা ফেরত দিচ্ছে। সুতরাং এটা মূলতঃ ফেরত নেওয়াই নয়। কিন্তু তিনি শুধু ঈজাবকে পূর্ণ হেবা এবং ফেরত দেওয়াকে ফেরত নেওয়া সাব্যস্ত করে সতর্কতা হিসেবে তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। [সূত্র : পছন্দিদাহ ওয়াকেআত, পৃষ্ঠা-১৪৫] [হৃদয় গলে সিরিজের ১৯নং খণ্ড থেকে পোস্টকৃত]
হৃদয় গলে সিরিজকে নিয়ে এক পাঠকের লেখা একটি কবিতা
সিরিজের গুণ
মুহাম্মদ আব্দুর রহমান, দড়াটানা মাদরাসা, যশোর
হৃদয় গলে সিরিজ তুমি কতই না প্রশংসনীয়
তোমার দ্বারা শিখেছি মোরা ঈমান অতি প্রিয়
তোমার মধ্যে কত যে গুণ যায় না তা তো ভোলা
মোদের মনটা পাষাণ ছিল হয়েছে এখন তুলা।
তোমার দ্বারা দ্বীন ঈমানের হয় যে কত কাজ
পর্দা যারা ছেড়ে ছিল, ধরেছে পর্দা আজ।
মোরা সবাই আশাবাদী, আজীবন তোমায় পাব
গ্রামে গঞ্জে তোমার প্রচার অবিরাম করে যাব।
হৃদয় গলে সিরিজের লেখকের সাথে সার্বিক যোগাযোগের ঠিকানা
মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম
নূরিয়া ইসলামিয়া মাদরাসা

Post a Comment

0 Comments