সন্তান হারিয়েছি, লজ্জা হারাইনি
_________________গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এক দুপুর, বৃক্ষের শাখায়, পত্র-পল্লবে বাতাসের কোন স্পন্দন নেই।স্বচ্ছ নীল আকাশে এক চিলতে মেঘও নেই যে, যাকে তাড়াতে এক গুচ্ছ বাতাস পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসবে। মেঘ আর বাতাসের বিরহে সূর্য ও যেন উন্মাদ হয়ে জ্ঞানশূন্য দিগ্বিদিক তাপ ছড়াচ্ছে । অসহ্য এ গরমে একটু ছাঁয়া, একটু হিমেল বাতাসের পরশ পেতে মনটা সবার আনচান করে কিন্তু বালুকাময় প্রান্তরে না আছে বাতাসের চিহ্ন আর না আছে ছাঁয়ার কোন নাম গন্ধ। সুবিস্তৃত মরুর বুক চিরে বয়ে চলা অসমতল এপথটির ধারে কোথাও কোথাও খেজুর বীথিকার দেখা মিললেও ছায়া দানে তা ব্যর্থ। একে তো মাথার উপর প্রখর দিবাকরের আগ্রাসী তাপ অন্য দিকে তাপবারিতে স্নাত হওয়া রাশি রাশি বালির ভাপ, সব মিলিয়ে উনুনে চড়ানো মাংসের মত সিদ্ধ হচ্ছিল ভরদুপুরের মরুপথচারীরা। তবুও চলতে হবে জীবনের প্রয়োজনে, প্রয়োজনের তাকিদে। থমকে দাঁড়ালে চলবেনা। ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে, ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে অভিন্ন পথে চলছে অনেকগুলো মানুষ। কেউ বা উটের পিঠে চড়ে, কেউ বা আবার পথের স্বল্পতার দরুন কিম্বা অসামর্থের কারনে পায়ে হেটে।এই মধ্য দুপুরের পথযাত্রীদের মাঝে ঢিলে ঢালা বোরকা পরিহিতা একজন মহিলাও রয়েছেন। যিনি অথৈ ভাবনার জলরাশি মাথায় নিয়ে ছুটে চলছেন আপন গন্তব্যে। একটি প্রশ্ন ও কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেতে পথের কষ্ট ও অসহ্য গরমের কথা ভুলে গেছেন এই বোরকা- আবৃত মধ্য বয়সী মাতাটি। নাম উম্মে খাল্লাদ। প্রিয় নবীর সাহাবী। গন্তব্য তার কোথাও নয় রাসূলের দরবার ছাড়া। ঘামে উবুজুবু এই আরব্য নারীর উর্ধশ্বাসে ছুটে চলা সূর্যের প্রখরতার কারনে নয়। গরমের তীব্রতার কারনে ও নয়।বরং মনের গভীরে উত্থিত একটি প্রশ্ন, একটি অস্ফুট সংশয় যা তাকে অস্থির করে তুলেছে তা নিরশনের জন্য।তিনি ছুটছেন তো ছুটছেন। উগ্র হরিণীর মত।লালচে নারাংগী বালির পথ মাড়িয়ে। মাথার উপর সূর্য জ্বলছে ঝলমলে আলোর প্লাবনে সাঁতার কাটছে গোটা মরুভূমি। একধ্যানে, একমনে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্য পথে। পথের ধারে জেগে উঠা কঁচি ফিকে সবুজ ঘাস বা ক্ষীণ দেহ লম্বা পাখা বিশিষ্ট পান্না সবুজ পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কিম্বা ঝুম ঝুম শব্দে জমি ছেড়ে উঠা ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল। কোন কিছুই তার গভীর ভাবনায় সামান্য ছেদ ফেলছে না। অথবা তার চলার গতিতে হেরফের আনছে না।সব কিছুই তপ্ত এবং বিষন্ন,এই জ্বালাময় বিষন্নতার মাঝে বাতাসের একটি প্রাণ জুড়ানো নিঃশ্বাস অনুভব করলেন, তার ঝিরঝির ধ্বনি শুনলেন মরুচারিণী উম্মে খাল্লাদ। যখন কল্পনার চোখে তিনি তার সদ্য প্রয়াত সন্তানকে সবুজ পাখি হয়ে জান্নাতে উড়তে দেখলেন। এ ডাল থেকে ও ডালে। কী শান্ত!কী স্নিগ্ধতার বলয়ে। সুখ স্রোতে ভাসমান সন্তানের এই দৃশ্য কল্পনা করে দরদী মা আনমনে একটু হাসলেন এ যেন নকাবের আড়ালে সংক্ষিপ্ত ঢেউ তোলা নিঃশব্দ হাসি।
পথটি প্রায় শেষের দিকে। ঐ তো গন্তব্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিরব গ্রামের অগ্রভাগ থেকে প্রবাহিত হয়ে উচ্ছাসিত শহরের প্রাণকেন্দ্রে এসে ঠেকেছে এই মরুপথটি।
প্রখর দিবাকর মাথায় নিয়ে দীর্ঘ এ পথের সিঁড়ি ভাঙ্গা শেষ আর কয়েক কদম এগুলেই প্রিয় নবীর মজমা। চন্দ্রকে কেন্দ্র করে যেমন নক্ষত্র রাজি গোলাকার হয়ে থাকে তেমনি রাসূল (সাঃ) এর চারপাশে তার প্রিয় সাহাবারা গোল হয়ে বসেছেন।
উম্মে খাল্লাদ সালাম দিয়ে সেখানে প্রবেশ করলেন। সারা অঙ্গ যেমন বোরকায় ঢাকা তেমনি তার চেহারাও নেকাবে ঢাকা। তিনি এসেছেন সুদূর পথ মাড়িয়ে, গ্রীষ্মের তাপের মাঝে সাঁতার কেটে।
এসেছেন সদ্য শাহাদাত বরণকারী সন্তান সম্পর্কে মহানবীর নিকট জানতে। কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে তিনি তৃপ্ত, পথের ক্লান্তি,সফরের কষ্ট সব যেন উবে গেছে। অদ্ভুত এক হিমেল পরশে তার তনু-মন উচ্ছাসিত। ফিরবেন এখন সেই পথে, যে পথ ধরে তিনি এসেছিলেন।
হঠাত্ এক সাহাবী তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ "তুমি তোমার শাহাদাত বরণকারী সন্তান সম্পর্কে জানতে এসেছ, এমন শোকের মুহুর্তেও তোমার চেহারা নেকাবে ঢাকা! আকস্মিক এ প্রশ্নে তিনি কিছু টা হতভম্ব,কিছুটা অপ্রস্তুত।উত্তরে তিনি কী বলবেন? পুরো মজমা হা মুখে তাকিয়ে আছে।একজন অবলা নারীর পক্ষে কিইবা উত্তর হতে পারে এমন উদ্ভট প্রশ্নের। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। মুহুর্তের মধ্যে থেমে গেল মজমার শোরগোল,পৃথিবী যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হল।নিরাবতার আস্তর ভেদ করে তিনি যে উত্তরটি দিয়েছিলেন, তা একদিকে যেমন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ জবাব,তেমনি গোটা পৃথিবীর মুসলিম রমণীদের জন্য অদ্বিতীয় পাথেয়। আত্ম মর্যাদা সম্পন্না এ মহিলা সাহাবী সবার চোখে আশ্চর্যের তকমা লাগিয়ে তেজদীপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেনঃ-" সন্তান হারিয়েছি,লজ্জা হারাইনি"।
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং 2488
Abu Hammad Shamim
0 Comments