অশ্রু ঝরা একটি গল্প (মাতৃছায়া)

 মুজীবুর রাহমান মুজীব
সেদিনের আকাশে মেঘের ঘনঘটা ছিল বেশ ৷ থেমে থেমে বৃষ্টি পড়েছে সারা দিন। পরিবেশটা ছিল শান্ত ৷ প্রকৃতি ছিল সজীব ও সতেজ ৷ বৃষ্টির দিনে তোমার অভ্যেস ছিল সব্জি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করা। সেদিন সকালেও তুমি সব্জির খিচুরি রান্না করেছিলে । আমের আচার মেখে দুজনে একথালাতে খেয়েছিলাম তোমার রান্না করা সেই খিচুড়ি। আরেকদিনের কথা। রাতের শেষ প্রহর ৷ সুবহে সাদিকের পুর্ব মুহুর্ত। এ সময়টাতে এমনিতেই ঘুমটা একটু গাঢ় হয়ে থাকে ৷ আর সেদিন বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে ঘুমের মাত্রাটাও ছিল অন্য দিনের তুলনায় ঢের বেশি ৷ নিত্যদিনের রুটিন মাফিক সেদিনও তুমি তাহাজ্জুদের জন্য আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি সুরে ডাকছিলে। আর আমি অলসতার কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েই ছিলাম। উঠছিলাম না। শীত ও বৃষ্টির দিনে কম্বলের বাইরের চেয়ে অন্দরটা বেশ আরামদায়ক ৷ আমি এমন একটা আরাম আরাম অনুভূতি রেখে উঠতে চাইছিলাম না ৷ তুমি নতুন কৌশল অবলম্বন করলে। বার বার চোখে মুখে পানি ছিটাতে থাকলে। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠে দুজনেই ফ্রেশ হলাম ৷ তাহাজ্জুদ আদায় করলাম। সেদিন সকালেও খুব বৃষ্টি হল। তুমি জানালার পাশে বসে সুমধুর কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করছিলে। সহসা তোমার দৃষ্টি পড়লো পুকুর পাড়ের কদম গাছটির দিকে ৷ অপলক তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ ৷ এরপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলে এবং আমাকে তোমার কাছে ডাকলে ৷ আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে একদম তোমার কাছে নিয়ে বললে, এই কদম গাছটির চূড়ায় একটু তাকাওতো। আমি তাকলাম । কিছু দেখতে পেলে?..হু। দুটি চড়ুই পাখি। রহমতের বারিধারায় সিক্ত হচ্ছে। তখন তুমি কচি খুকির মত বলেছিলে, "এই চলোনা আমরাও বৃষ্টিতে ভিজি। রহমতের বারিধারায় সিক্ত হই। তোমার আবদার রক্ষার্থে সেদিন আমরা বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম ৷ রহমতের বারিধারায় সিক্ত হয়েছিলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেদিন তুমি প্রার্থনা করেছিলে, হে রব! তোমার হাবীব(সাঃ) বলেছেন, বৃষ্টির সময় যখন কেউ তোমার কাছে প্রার্থনা করে তুমি তার প্রার্থনা কবুল করো। হে করুনাময়! আমি প্রার্থনা করছি, আমার গর্ভে তুমি যে রত্ন দিয়েছো তাকে কুরআনের হাফেজ বা হাফেজা হিসেবে কবুল করো"। আমি সেদিন কী যে অভিভৃত হয়েছিলাম তোমাকে বোঝাতে পারিনি। আজো পারবনা। অভিভূত হবনা! এমন বউ এর জন্যইতো রবের কাছে প্রার্থনা করতাম। তুমি কি জানো? যে গর্বের ধন নিশাতকে তুমি দুনিয়ার আলো-বাতাস দেখানোর জন্যে , হাফেজা বানানোর জন্যে আঁতুরঘরে শহীদের মর্যাদা লাভ করেছিলে, সে আজ কত বড় হয়েছে?। গতকাল তার দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। চলনে বলনে সর্বদিক থেকে সে তোমার মত হয়েছে। বৃষ্টির দিনে তারও তোমার মত আমের আচার মেখে খিচুড়ি খেতে ভালো লাগে। সেও সারাক্ষণ তোমার মত গুনগুনিয়ে মধুর সুরে কুরআন তেলাওয়াত করে। এই বয়সেই প্রতিদিন তাহাজ্জুদ আদায় করে।সে যেদিন ঘুম থেকে আগে উঠবে সেদিন ঠিক তোমার মত মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকবে। আব্বু! ও আব্বু!! তাহাজ্জুদের সময় হয়েগেছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। সে গতরাতে আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।সে কি বলেছিল জানো? সে বলেছিল, আচ্ছা আব্বু! তোমার যখন আম্মুর কথা মনে হয় তখন তুমি কী করো? আমি বললাম, কী আর করি। মন খারাপ করে বসে থাকি। তখন সে কী বলল জানো? সে বলল । আম্মুর কথা যখন স্বরণ হয় আমারো খুব খারাপ লাগে। তবে আমি শুধু মন খারাপ করে বসে থাকিনা। বরং সুরা ইয়াসিন পাঠ করে আমি আম্মুর জন্যে ইসালে সওয়াব করি। হৃদয়ের গভীর থেকে 'রাব্বির হাম হুমা কামা রাববা ইয়ানী সাগিরাহ' পড়ি। অাজ সকাল থেকে নিশাত খুব কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার ছোট ছোট নিষ্পাপ চোখ দুটো লাল টকটকে হয়েগেছে। বেদেনার দানার মত দুগাল বেয়ে তপ্ত অশ্রু নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আমিও আজ খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি। সেই কদম গাছটির কথা; বৃষ্টিতে ভেজা দিনগুলোর কথা বার বার মনে পড়ছে। কেন জান?কারণ, অাজ তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। নিশাত আজ কুরআনের হাফেজা হয়েছে।
 মাসিক পুষ্পকলি সেপ্টেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি গল্প।

Post a Comment

0 Comments