রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-
প্রশ্ন: কিভাবে একজন মানুষ অহংকার
থেকে মুক্তি পেতে পারে?
উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
অহংকার একটি খারাপ গুণ। এটি
ইবলিস ও দুনিয়ায় তার সৈনিকদের
বৈশিষ্ট্য; আল্লাহ যাদের অন্তর
আলোহীন করে দিয়েছেন।
সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির উপর
যে অহংকার করেছিল সে হচ্ছে—
লানতপ্রাপ্ত ইবলিস। যখন আল্লাহ
তাকে নির্দেশ দিলেন— আদমকে
সেজদা কর; তখন সে অসম্মতি
জানিয়ে বলল: “আমি তার চেয়ে উত্তম।
আমাকে বানিয়েছেন আগুন দিয়ে;
তাকে বানিয়েছেন মাটি দিয়ে।”
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি
করলাম, এরপর আকার-অবয়ব তৈরি
করেছি। অতঃপর আমি
ফেরেশতাদেরকে বললাম – আদমকে
সেজদা কর; তখন সবাই সেজদা করল।
কিন্তু ইবলিস সেজদাকারীদের মধ্যে
ছিল না। আল্লাহ বললেন: আমি যখন
তোকে সেজদা করার আদেশ দিলাম
তখন কিসে তোকে সেজদা করতে
বাধা দিল? সে বলল: আমি তার চেয়ে
উত্তম। আমাকে বানিয়েছেন আগুন
দিয়ে; তাকে বানিয়েছেন মাটি
দিয়ে।” [ সূরা আরাফ, আয়াত: ১১-১২ ]
তাই অহংকার ইবলিসি চরিত্র। যে
ব্যক্তি অহংকার করতে চায় সে জেনে
রাখুক সে শয়তানের চরিত্র গ্রহণ
করেছে। সে সম্মানিত ফেরেশতাদের
চরিত্র গ্রহণ করেনি, যারা আল্লাহর
আনুগত্য করে সেজদায় লুটিয়ে
পড়েছিল।
অহংকার অহংকারীর জান্নাত থেকে
বঞ্চিত হওয়ার কারণ, ইজ্জতের মালিক
আল্লাহকে সরাসরি দেখতে না
পাওয়ার কারণ। দলিল হচ্ছে এ দুইটি
হাদিস:
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে
বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা
করেন তিনি বলেন: “যার অন্তরে বিন্দু
পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে
প্রবেশ করবে না। একলোক বলল: যে
কোন লোক পছন্দ করে তার জামাটা
ভাল হোক, তার জুতাটা ভাল হোক?
তিনি বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর;
তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার
হচ্ছে – সত্যকে উপেক্ষা করা এবং
মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।” [ সহিহ
মুসলিম ]
সত্যকে উপেক্ষার অর্থ: সত্য জেনেও
সেটাকে প্রত্যাখ্যান করা।
মানুষকে তুচ্ছ করার অর্থ: মানুষকে
ছোট করা, হেয় করা।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে
বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন: “যে ব্যক্তি অহংকারবশতঃ
কাপড় ঝুলিয়ে হাঁটবে কিয়ামতের দিন
আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না। আবু
বকর (রাঃ) বললেন: আমার কাপড়ের
একটা অংশ ঝুলে পড়ে যায়; আমি
বারবার সেটাকে টেনে নেই। তখন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বললেন: তুমি তো
অহংকারবশতঃ সেটা কর না।” [ সহিহ
বুখারী – ৩৪৬৫]
দুই:
অহংকার এমন একটি গুণ যা শুধু
আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি এ
গুণ নিয়ে আল্লাহর সাথে টানাটানি
করে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন,
তার প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার
জীবনকে সংকুচিত করে দেন।
আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) ও আবু হুরায়রা
(রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা
বলেছেন: সম্মান হচ্ছে- আল্লাহর
পরনের কাপড়; আর অহংকার হচ্ছে-
আল্লাহর চাদর। যে ব্যক্তি এটা নিয়ে
আমার সাথে টানাটানি করে আমি
তাকে শাস্তি দেই।” [ সহিহ মুসলিম –
২৬২০]
নববী বলেন:
সহিহ মুসলিমের সব কপিতে এভাবে
আছে। ﺍﺯﺍﺭﻩ ও ﺭﺩﺍﺅﻩ শব্দদ্বয়ের ﻩ জমির
(সর্বনাম) দ্বারা আল্লাহকে বুঝানো
হচ্ছে। এখানে বাক্যের কিছু অংশ উহ্য
রয়েছে সেটা হচ্ছে- ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ : ﻭﻣﻦ
ﻳﻨﺎﺯﻋﻨﻲ ﺫﻟﻚ ﺃﻋﺬﺑﻪ ( অর্থঃ আল্লাহ বলেন:
যে ব্যক্তি সেটা নিয়ে আমার সাথে
টানাটানি করবে আমি তাকে শাস্তি
দিব)
আমার সাথে ‘টানাটানি’ করবে এর
অর্থ- এ গুণ লালন করবে; ফলে সে
অংশীদার এর পর্যায়ে পড়বে। এটি
অহংকারের কঠিন শাস্তি ও অহংকার
হারাম হওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা।[ শারহু
মুসলিম (১৬/১৭৩)]
যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় ও
বড়ত্ব দেখাতে চায় আল্লাহ তাকে
নীচে ছুড়ে ফেলে দেন ও বেইজ্জত
করেন। যেহেতু সে তার মূলপরিচয়ের
বিপরীতে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা
করেছে তাই আল্লাহ তাকে তার ইচ্ছার
বিপরীতে শাস্তি দিয়ে দেন। বলা হয়:
শাস্তি আমলের সম জাতীয় হয়ে
থাকে।
যে ব্যক্তি মানুষের উপর অহংকার করে
কিয়ামতের দিন তাকে মানুষের
পায়ের নীচে মাড়ানো হবে। এভাবে
আল্লাহ তাআলা অহংকারের কারণে
তাকে লাঞ্ছিত করবেন।
আমর ইবনে শুয়াইব তার পিতা থেকে
তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন
তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি
বলেন: “কিয়ামতের দিন
অহংকারীদেরকে ছোট ছোট
পিপীলিকার ন্যায় মানুষের আকৃতিতে
হাশরের ময়দানে উপস্থিত করা হবে।
অপমান ও লাঞ্ছনা তাদেরকে
চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবে।
তাদেরকে জাহান্নামের একটি
জেলখানায় একত্রিত করা হবে, যার
নাম হবে “বুলাস। আগুন তাদেরকে
চতুর্দিক থেকে ঢেকে ফেলবে।
জাহান্নামীদের শরীরের ঘাম
তাদেরকে পান করতে বাধ্য করা
হবে।”। [সুনানে তিরমিজি – ২৪৯২,
আলবানী সহিহ তিরমিজি গ্রন্থে –
২০১৫ এ হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]
তিন:
অহংকারের নানান রূপ রয়েছে:
১. সত্যকে গ্রহণ না করা; অন্যায়ভাবে
বিতর্ক করা। যেমনটি আমরা
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের হাদিসে
উল্লেখ করেছি। “অহংকার হচ্ছে-
সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে
তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।”
২. নিজের সৌন্দর্য্য, দামী পোশাক ও
দামী খাবার ইত্যাদি দ্বারা অভিভূত
হয়ে পড়া এবং মানুষের উপর
দাম্ভিকতা ও অহংকার প্রকাশ করা।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি
বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম অথবা আবুল কাসেম বলেছেন:
একদা এক ব্যক্তি হুল্লা পরে,
আত্মম্ভরিতা নিয়ে, মাথা আঁচড়িয়ে
হাঁটছিল এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে
সহ ভূমি ধ্বস করে দিলেন এবং এভাবে
কিয়ামত পর্যন্ত সে নীচের দিকে
যেতে থাকবে।”[সহিহ বুখারি – ৩২৯৭ ও
সহিহ মুসলিম – ২০৮৮]
এ ধরণের অহংকারের মধ্যে ঐ ব্যক্তির
আচরণও পড়বে যার ব্যাপারে আল্লাহ
তাআলা বলেছেন:
“সে ফল পেল। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে
সঙ্গীকে বললঃ আমার ধন-সম্পদ
তোমার চাইতে বেশী এবং জনবলে
আমি অধিক শক্তিশালী।” [ সূরা
কাহাফ, আয়াত: ৩৪]
কখনো কখনো আত্মীয়স্বজন ও
বংশধরদের নিয়ে গৌরবের মাধ্যমেও
অহংকার হতে পারে.
চার:
অহংকার প্রতিরোধ করার উপায় হল-
নিজেকে অন্য দশজন মানুষের মত মনে
করা। অন্যসব লোককে নিজের সমতুল্য
মনে করা। তারাও এক বাপ-মা থেকে
জন্মগ্রহণ করেছে। যেভাবে আপনিও
এক বাপ-মা এর ঘরে জন্মগ্রহণ
করেছেন। আর আল্লাহভীতি ব্যক্তির
মর্যাদা পরিমাপের মানদণ্ড। আল্লাহ
তাআলা বলেন:
“নিশ্চয় তোমাদের যে ব্যক্তি বেশি
তাকওয়াবান সে আল্লাহর নিকট
বেশি সম্মানিত।” [ সূরা হুজুরাত,
আয়াত: ১৩]
অহংকারী মুসলিমের জানা থাকা
উচিত সে যতই বড় হোক না কেন পাহাড়
সমান তো আর হতে পারবে না; জমিন
ছিদ্র করে তো বেরিয়ে যেতে পারবে
না। যেমনটি আল্লাহ তাআলা
বলেছেন:
“অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা
করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে
পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ
কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ
করেন না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা
অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নীচু কর।
নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই
সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।” [ সূরা
লোকমান, আয়াত: ১৭-১৮]
ইমাম কুরতুবী বলেন:
“পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না”
এখানে অহংকার থেকে বারণ করা
হয়েছে এবং বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ
দেয়া হয়েছে। আয়াতে ﺍﻟﻤﺮﺡ শব্দের
অর্থ- তীব্র আনন্দ। কেউ কেউ বলেছেন:
হাঁটার মধ্যে অহংকার করা, কেউ
বলেছেন: কোন মানুষের তার মর্যাদার
সীমা অতিক্রম করে যাওয়া।
কাতাদা বলেছেন: হাঁটার ক্ষেত্রে
অহংকার। কেউ কেউ বলেছেন:
প্রত্যাখান। কেউ কেউ বলেছেন: উদ্যম।
এ উক্তিগুলো সমার্থবোধক। কিন্তু
এগুলো দুইভাগে বিভক্ত:
একটি: নন্দিত অপরটি: নিন্দিত।
অহংকার, প্রত্যাখান, দাম্ভিকতা
এবং কোন মানুষের তার সীমা
অতিক্রম করা: নিন্দিত।
আর আনন্দ ও উদ্যমতা: নন্দিত।
[ তাফসিরে কুরতুবী ১০/২৬০]
অহংকার প্রতিরোধ করার আরেকটি
উপায় হলো- এটি মনে রাখা যে,
অহংকারীকে কিয়ামতের দিন
পিঁপড়ার ন্যায় ছোট করে হাশর করা
হবে মানুষের পায়ের নীচে মাড়ানো
হবে। অহংকারী মানুষের নিকট
অপছন্দীয় যেমনিভাবে সে আল্লাহর
নিকটও অপছন্দনীয়। মানুষ বিনয়ী, নম্র,
ভদ্র, সহজ, সরল মানুষকে ভালবাসে।
আর কঠিন ও রুঢ় স্বভাবের মানুষকে ঘৃণা
করে।
অহংকার প্রতিরোধ করার আরেকটি
উপায় হলো- অহংকারী যে পথ দিয়ে
বের হয়েছে পেশাবও সে পথ দিয়ে
বের হয়। তার সৃষ্টির সূচনা হয়েছে
নাপাক বীর্য থেকে। তার সর্বশেষ
পরিণতি হচ্ছে- পচা লাশ। এ দুই
অবস্থার মাঝখানে সে পায়খানা বহন
করে চলছে। সুতরাং অহংকার করার মত
কী আছে?!!
আমরা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা
করছি তিনি যেন আমাদেরকে
অহংকার থেকে মুক্তি দেন এবং
আমাদেরকে বিনয় দান করেন।
আল্লাহই ভাল জানেন।
0 Comments