ত্যাগের এক বিস্ময়কর নমুনা
মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম
[লেখক, হৃদয় গলে সিরিজ]
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ.। তিনি ছিলেন সমকালীন মুসলিম বিশ্বের সেরা আলিম ও শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ। সেই সাথে হযরত সাহাবায়ে কেরামের শেষ যুগে পবিত্র ইসলামের আলোকধারার মহান সংরক্ষক ও সাধক পুরুষদের অগ্রপথিকও ছিলেন তিনি।
কুখ্যাত শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ.কে দু'চোখে দেখতে পারত না। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা সহমর্মিতা কোনোটাই ছিল না তার। সে কতিপয় মহামনীষীকে শত্র“ হিসেবে চিহিৃত করে দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পৈশাচিক আচরণ ও নিষ্ঠুর নিপীড়নের মাধ্যমে সবুজ শ্যামল এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদায় দেওয়ার। এসব মনীষীদের তালিকায় হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ. ছিলেন অন্যতম। তাই হাজ্জাজের পুলিশ সর্বদাই তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অনুসন্ধান করে ফিরছিল গ্রাম-গঞ্জ ও শহর-বন্দরসহ দেশের সকল স্থানে।
হযরত নাখাঈ রহ. এ সংবাদ জানার পর আÍগোপন করে থাকতেন। লোকসমাজে খুব একটা বের হতেন না। গোপনেই প্রচার করতেন ইসলামের মর্মবাণী।
সে সময় আরেকজন বুযুর্গ ছিলেন। নাম ইবরাহীম তাঈমী রহ.। দয়ামায়া ও উদারতার এক উজ্জ্বল প্রদীপ ছিলেন তিনি। হাজ্জাজের চিহিৃত তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। সুতরাং গ্রেফতার হওয়ার কোনো ভয়ও ছিল না তাঁর।
একদিন এক মুনাফিক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের গোয়েন্দা পুলিশের নিকট হাজির হলো। বলল, হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ. অমুক স্থানে অবস্থান করছেন। সংবাদ পেয়ে পুলিশ তো মহাখুশি। তারা মুনাফিক লোকটিকে বাহবা দিয়ে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে। দীর্ঘদিন যাবত এমন একটা সংবাদের জন্যই অপো করছিলাম আমরা।
সংবাদটি মূলত ভুল ছিল। সংবাদদাতা জানত না যে, ইবরাহীম নাখাঈ রহ. আর ইবরাহীম তাঈমী রহ. এক ব্যক্তি নন। সে যার ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কাছে খবর দিয়েছিল, তিনি আসলে ইবরাহীম নাখাঈ রহ. ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইবরাহীম তাঈমী রহ.। উপরন্তু গোয়েন্দারাও হযরত নাখাঈ রহ.কে চেহারা-সুরতে চিনত না। কারণ তারা কেউ কোনোদিন তাঁকে দেখে নি।
সংবাদ পাওয়ার পর গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। তারা সরাসরি হাজির হলো হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. এর দরবারে। অবশ্য হযরত তাঈমী রহ.ও জানতেন যে, পুলিশ মূলত তাকে খুঁজছে না। খুঁজছে ইবরাহীম নাখাঈ রহ.কে।
সবকিছু জেনেও মায়া আর সহমর্মিতার মূর্ত প্রতীক হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. মানবতার ইতিহাসে স্থাপন করলেন ত্যাগ আদর্শের এক বিস্ময়কর নমুনা। পেশ করলেন এমন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত পৃথিবীর সকল মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
গোয়েন্দা পুলিশ তাঁর নিকট হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করল-
আপনার নাম? আপনার পরিচয়?
আমার নাম ইবরাহীম। হযরতের ভীতিহীন জবাব।
আপনিই তাহলে ইবরাহীম? যাকে আমরা হন্যে হয়ে খুঁজছি!
কাকে খুঁজছেন সেটা আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন। তবে আমার নাম যে ইবরাহীম সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।
পুলিশের খুশি এবার দেখে কে! তারা ভাবল, শিকার পেয়ে গেছি। আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ সহজেই বাস্তবায়িত হয়েছে। এতবড় একজন বড়মাপের আসামীকে এত সহজে পাকড়াও করতে পারব, তা কল্পনায়ও ছিল না আমাদের।
হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. আর একটি কথাও বলেননি। বলার অবশ্য প্রয়োজনও পড়ে নি। পুলিশের লোকেরা তাকে গ্রেফতার করে টেনে হেচঁড়ে জেলখানায় নিয়ে গেল। বন্দী করল এমন এক দুর্বিষহ কারাগারে যেখানে আলো বাতাস পৌঁছবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না শীত কিংবা গরম থেকে আÍরার কোনো আসবাবও। অধিকন্তু তার সাথে শিকল দিয়ে জুড়ে দেওয়া হলো আরেকজন দাগী আসামীকে। ফলে মানবীয় প্রয়োজন সারতে গেলেও অপরজনকে সঙ্গে না নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। পাশবিকতার কী করুণ ইতিহাস!
জেলখানায় হযরত তাঈমী রহ. এর উপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। খাবার দেওয়া হতো খুবই সামান্য। এসব খাবার জীবন ধারণের জন্য যেমন যথেষ্ট ছিল না, তেমনি ছিল না খাওয়ার উপযোগীও। খোদাপ্রেমিক এ বুজুর্গের জন্য প্রতিদিন উদ্ভাবিত হতো নির্যাতন ও নিপীড়নের নতুন কৌশল।
প্রচণ্ড শীত, অসীম ক্ষুধা আর সীমাহীন নির্যাতনে নেষ্পেষিত হয়ে বয়সের ভারে কান্ত এ মনীষী খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিল তাঁর গোটা দেহ। দুর্বলতার মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, তাঁর শ্রদ্ধেয় জননী যখন সংবাদ পেয়ে কারাগারে তাঁকে দেখতে যান, তখন তিনি আপন সন্তানকে চিনতে পারছিলেন না। ভাবতেও পারছিলেন না, হাজ্জাজের পাষণ্ড জল্লাদরা তাঁর কলিজার টুকরা সন্তানকে নির্যাতনের স্টীম রোলার চালিয়ে এরূপ অবস্থায় উপনীত করতে পারে। তিনি জানতেন, হাজ্জাজ নিষ্ঠুর, হাজ্জাজ জালেম, হাজ্জাজ নির্মম। কিন্তু একজন খোদা প্রেমিক আল্লাহ ওয়ালার উপর তাঁর নির্মমতা এতটা মারাÍক আকারে প্রকাশ পাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেন নি।
হাজ্জাজের পেটুয়া বাহিনী তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে জেলখানার মধ্যেই হযরত তাঈমী রহ.কে হত্যা করে। জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠই হয় হযরতের শাহাদাতগাহ। সেখানেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
শাহাদাতের কয়েকদিন পূর্বে ভক্তজনেরা তাঁকে এক নযর দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তারা জিজ্ঞেস করেছিল, হযরত! পুলিশ তো সেদিন আপনাকে গ্রেফতার করতে আসেনি। এসেছিল, হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ. কে গ্রেফতার করতে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কালো তালিকায় নাম ছিল তাঁরই। তথাপি আপনি নিজকে ধরা দিতে গেলেন কেন? আপনি যদি শুধু এতটুকু বলতেন যে, আমি ইবরাহীম নাখাঈ নই, ইবরাহীম তাঈমী; বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখো, তবেই তো সব কিচ্ছা খতম হয়ে যেত। আপনি রেহাই পেয়ে যেতেন কষ্ট-মসীবত থেকে। নিষ্কৃতি পেতেন হাজ্জাজ বাহিনীর নিষ্ঠুর নিপীড়ন থেকে।
জবাবে হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. বললেন, দেখো, আমি জানি, হাজ্জাজের শত্র“দের তালিকায় আমার নাম নেই। আমি এও জানি যে, গোয়েন্দা পুলিশ আমাকে খুঁজছে না, খুঁজছে হযরত ইবরাহীম নাখাঈকে। তারপরও আমি নিজকে কেন ধরিয়ে দিলাম, এই তো তোমাদের প্রশ্ন?
হ্যাঁ, এটাই তো আমরা জানতে চাচ্ছি।
শোনো। সেদিন যখন গোয়েন্দা পুলিশ আমার সামনে হাজির হলো, তখন আমি ভাবলাম, ইবরাহীম নাখাঈ একজন সমকালীন ইমাম। মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় রাহবর তিনি। তাঁর মতো একজন মহান ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবেন তা আমার পছন্দ হয় নি। তাই নিজেকেই ধরিয়ে দিয়েছি।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! ধর্মীয় চিন্তাকে মাথায় রেখে অপরকে বিপদমুক্ত করার এমন আলোকোজ্জ্বল উপমা বিরল নয় কি? হে মহিমাময় প্রভু! আমাদেরকেও তুমি দীনের খাতিরে মানব কল্যাণে বড় থেকে বড় কুরবানী পেশ করার তাওফীক দান করো। আমীন। (কাশকুল : পৃষ্ঠা, ২০৮)
বিশেষ দ্রষ্টব্য : এ ঘটনাটি হৃদয় গলে সিরিজের ২০নং খণ্ড থেকে পোস্ট করা হলো]
হৃদয় গলে সিরিজ সম্পর্কে একজন পাঠকের অভিব্যক্তি
প্রিয় বড় ভাই! প্রথমে আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। পর কথা হলো, আমি হৃদয় গলে সিরিজের ৪টি বই পড়ে এত খুশি হয়েছি যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব তাও খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মনে করি, যদি কোনো দুশ্চরিত্র ছেলে-মেয়েও মন দিয়ে বইগুলো পড়ে, তবে আল্লাহর রহমতে তাদের জীবনে পরিবর্তন আসবেই। যারা মা বাবার মনে কষ্ট দেয়, তারা যদি এ বইগুলো পড়ে তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জীবনে তারা কোনোদিন মা বাবার মনে কষ্ট দিবে না। যখন আমি সিরিজের কোনো গল্প পড়তে শুরু করি, তখন আমার চোখের দু কোণ অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠে। যে এ বইগুলো পড়বে, তার কান্না আসবেই। সত্যি আমি যদি আপনাকে কাছে পেতাম তবে পেট ভরিয়ে মিষ্টি খাওয়াতাম। আল্লাহ পাক আপনাকে আরো সুন্দর সুন্দর বই লিখার তাওফীক দান করুন।
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ.। তিনি ছিলেন সমকালীন মুসলিম বিশ্বের সেরা আলিম ও শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ। সেই সাথে হযরত সাহাবায়ে কেরামের শেষ যুগে পবিত্র ইসলামের আলোকধারার মহান সংরক্ষক ও সাধক পুরুষদের অগ্রপথিকও ছিলেন তিনি।
কুখ্যাত শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ.কে দু'চোখে দেখতে পারত না। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা সহমর্মিতা কোনোটাই ছিল না তার। সে কতিপয় মহামনীষীকে শত্র“ হিসেবে চিহিৃত করে দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পৈশাচিক আচরণ ও নিষ্ঠুর নিপীড়নের মাধ্যমে সবুজ শ্যামল এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদায় দেওয়ার। এসব মনীষীদের তালিকায় হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ. ছিলেন অন্যতম। তাই হাজ্জাজের পুলিশ সর্বদাই তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অনুসন্ধান করে ফিরছিল গ্রাম-গঞ্জ ও শহর-বন্দরসহ দেশের সকল স্থানে।
হযরত নাখাঈ রহ. এ সংবাদ জানার পর আÍগোপন করে থাকতেন। লোকসমাজে খুব একটা বের হতেন না। গোপনেই প্রচার করতেন ইসলামের মর্মবাণী।
সে সময় আরেকজন বুযুর্গ ছিলেন। নাম ইবরাহীম তাঈমী রহ.। দয়ামায়া ও উদারতার এক উজ্জ্বল প্রদীপ ছিলেন তিনি। হাজ্জাজের চিহিৃত তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। সুতরাং গ্রেফতার হওয়ার কোনো ভয়ও ছিল না তাঁর।
একদিন এক মুনাফিক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের গোয়েন্দা পুলিশের নিকট হাজির হলো। বলল, হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ. অমুক স্থানে অবস্থান করছেন। সংবাদ পেয়ে পুলিশ তো মহাখুশি। তারা মুনাফিক লোকটিকে বাহবা দিয়ে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে। দীর্ঘদিন যাবত এমন একটা সংবাদের জন্যই অপো করছিলাম আমরা।
সংবাদটি মূলত ভুল ছিল। সংবাদদাতা জানত না যে, ইবরাহীম নাখাঈ রহ. আর ইবরাহীম তাঈমী রহ. এক ব্যক্তি নন। সে যার ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কাছে খবর দিয়েছিল, তিনি আসলে ইবরাহীম নাখাঈ রহ. ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইবরাহীম তাঈমী রহ.। উপরন্তু গোয়েন্দারাও হযরত নাখাঈ রহ.কে চেহারা-সুরতে চিনত না। কারণ তারা কেউ কোনোদিন তাঁকে দেখে নি।
সংবাদ পাওয়ার পর গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। তারা সরাসরি হাজির হলো হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. এর দরবারে। অবশ্য হযরত তাঈমী রহ.ও জানতেন যে, পুলিশ মূলত তাকে খুঁজছে না। খুঁজছে ইবরাহীম নাখাঈ রহ.কে।
সবকিছু জেনেও মায়া আর সহমর্মিতার মূর্ত প্রতীক হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. মানবতার ইতিহাসে স্থাপন করলেন ত্যাগ আদর্শের এক বিস্ময়কর নমুনা। পেশ করলেন এমন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত পৃথিবীর সকল মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
গোয়েন্দা পুলিশ তাঁর নিকট হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করল-
আপনার নাম? আপনার পরিচয়?
আমার নাম ইবরাহীম। হযরতের ভীতিহীন জবাব।
আপনিই তাহলে ইবরাহীম? যাকে আমরা হন্যে হয়ে খুঁজছি!
কাকে খুঁজছেন সেটা আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন। তবে আমার নাম যে ইবরাহীম সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।
পুলিশের খুশি এবার দেখে কে! তারা ভাবল, শিকার পেয়ে গেছি। আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ সহজেই বাস্তবায়িত হয়েছে। এতবড় একজন বড়মাপের আসামীকে এত সহজে পাকড়াও করতে পারব, তা কল্পনায়ও ছিল না আমাদের।
হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. আর একটি কথাও বলেননি। বলার অবশ্য প্রয়োজনও পড়ে নি। পুলিশের লোকেরা তাকে গ্রেফতার করে টেনে হেচঁড়ে জেলখানায় নিয়ে গেল। বন্দী করল এমন এক দুর্বিষহ কারাগারে যেখানে আলো বাতাস পৌঁছবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না শীত কিংবা গরম থেকে আÍরার কোনো আসবাবও। অধিকন্তু তার সাথে শিকল দিয়ে জুড়ে দেওয়া হলো আরেকজন দাগী আসামীকে। ফলে মানবীয় প্রয়োজন সারতে গেলেও অপরজনকে সঙ্গে না নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। পাশবিকতার কী করুণ ইতিহাস!
জেলখানায় হযরত তাঈমী রহ. এর উপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। খাবার দেওয়া হতো খুবই সামান্য। এসব খাবার জীবন ধারণের জন্য যেমন যথেষ্ট ছিল না, তেমনি ছিল না খাওয়ার উপযোগীও। খোদাপ্রেমিক এ বুজুর্গের জন্য প্রতিদিন উদ্ভাবিত হতো নির্যাতন ও নিপীড়নের নতুন কৌশল।
প্রচণ্ড শীত, অসীম ক্ষুধা আর সীমাহীন নির্যাতনে নেষ্পেষিত হয়ে বয়সের ভারে কান্ত এ মনীষী খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিল তাঁর গোটা দেহ। দুর্বলতার মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, তাঁর শ্রদ্ধেয় জননী যখন সংবাদ পেয়ে কারাগারে তাঁকে দেখতে যান, তখন তিনি আপন সন্তানকে চিনতে পারছিলেন না। ভাবতেও পারছিলেন না, হাজ্জাজের পাষণ্ড জল্লাদরা তাঁর কলিজার টুকরা সন্তানকে নির্যাতনের স্টীম রোলার চালিয়ে এরূপ অবস্থায় উপনীত করতে পারে। তিনি জানতেন, হাজ্জাজ নিষ্ঠুর, হাজ্জাজ জালেম, হাজ্জাজ নির্মম। কিন্তু একজন খোদা প্রেমিক আল্লাহ ওয়ালার উপর তাঁর নির্মমতা এতটা মারাÍক আকারে প্রকাশ পাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেন নি।
হাজ্জাজের পেটুয়া বাহিনী তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে জেলখানার মধ্যেই হযরত তাঈমী রহ.কে হত্যা করে। জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠই হয় হযরতের শাহাদাতগাহ। সেখানেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
শাহাদাতের কয়েকদিন পূর্বে ভক্তজনেরা তাঁকে এক নযর দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তারা জিজ্ঞেস করেছিল, হযরত! পুলিশ তো সেদিন আপনাকে গ্রেফতার করতে আসেনি। এসেছিল, হযরত ইবরাহীম নাখাঈ রহ. কে গ্রেফতার করতে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কালো তালিকায় নাম ছিল তাঁরই। তথাপি আপনি নিজকে ধরা দিতে গেলেন কেন? আপনি যদি শুধু এতটুকু বলতেন যে, আমি ইবরাহীম নাখাঈ নই, ইবরাহীম তাঈমী; বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখো, তবেই তো সব কিচ্ছা খতম হয়ে যেত। আপনি রেহাই পেয়ে যেতেন কষ্ট-মসীবত থেকে। নিষ্কৃতি পেতেন হাজ্জাজ বাহিনীর নিষ্ঠুর নিপীড়ন থেকে।
জবাবে হযরত ইবরাহীম তাঈমী রহ. বললেন, দেখো, আমি জানি, হাজ্জাজের শত্র“দের তালিকায় আমার নাম নেই। আমি এও জানি যে, গোয়েন্দা পুলিশ আমাকে খুঁজছে না, খুঁজছে হযরত ইবরাহীম নাখাঈকে। তারপরও আমি নিজকে কেন ধরিয়ে দিলাম, এই তো তোমাদের প্রশ্ন?
হ্যাঁ, এটাই তো আমরা জানতে চাচ্ছি।
শোনো। সেদিন যখন গোয়েন্দা পুলিশ আমার সামনে হাজির হলো, তখন আমি ভাবলাম, ইবরাহীম নাখাঈ একজন সমকালীন ইমাম। মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় রাহবর তিনি। তাঁর মতো একজন মহান ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবেন তা আমার পছন্দ হয় নি। তাই নিজেকেই ধরিয়ে দিয়েছি।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! ধর্মীয় চিন্তাকে মাথায় রেখে অপরকে বিপদমুক্ত করার এমন আলোকোজ্জ্বল উপমা বিরল নয় কি? হে মহিমাময় প্রভু! আমাদেরকেও তুমি দীনের খাতিরে মানব কল্যাণে বড় থেকে বড় কুরবানী পেশ করার তাওফীক দান করো। আমীন। (কাশকুল : পৃষ্ঠা, ২০৮)
বিশেষ দ্রষ্টব্য : এ ঘটনাটি হৃদয় গলে সিরিজের ২০নং খণ্ড থেকে পোস্ট করা হলো]
হৃদয় গলে সিরিজ সম্পর্কে একজন পাঠকের অভিব্যক্তি
প্রিয় বড় ভাই! প্রথমে আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। পর কথা হলো, আমি হৃদয় গলে সিরিজের ৪টি বই পড়ে এত খুশি হয়েছি যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব তাও খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মনে করি, যদি কোনো দুশ্চরিত্র ছেলে-মেয়েও মন দিয়ে বইগুলো পড়ে, তবে আল্লাহর রহমতে তাদের জীবনে পরিবর্তন আসবেই। যারা মা বাবার মনে কষ্ট দেয়, তারা যদি এ বইগুলো পড়ে তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জীবনে তারা কোনোদিন মা বাবার মনে কষ্ট দিবে না। যখন আমি সিরিজের কোনো গল্প পড়তে শুরু করি, তখন আমার চোখের দু কোণ অশ্র“সিক্ত হয়ে উঠে। যে এ বইগুলো পড়বে, তার কান্না আসবেই। সত্যি আমি যদি আপনাকে কাছে পেতাম তবে পেট ভরিয়ে মিষ্টি খাওয়াতাম। আল্লাহ পাক আপনাকে আরো সুন্দর সুন্দর বই লিখার তাওফীক দান করুন।
0 Comments