পিতা মারা যায় শৈশবকালেই

ছোট্ট একটি নাম আব্দুল খালেক।

পিতা মারা যায় শৈশবকালেই। 

ফলে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় শিশু আব্দুল খালেক। এখন বেঁচে আছেন শুধু স্নেহময়ী মা। ওর একমাত্র অভিভাবক এখন মা-ই। মা ছাড়া এ জগতে আর কেউ নেই তার।
আব্দুল খালেকের মায়ের নাম ফাতেমা বেগম। সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে অন্য কোথাও বিবাহ বসেননি তিনি। তার ইচ্ছা, বাকি জীবন ছেলে আব্দুল খালেককে নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া। সেই সাথে ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
আব্দুল খালেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সংসারে সবসময় অভাব-অনটন লেগে থাকায় কোনো দিনই ওর পিতার পে স্ত্রী-পুত্রের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করার সুযোগ হয়নি। ভাবতে পারেননি ওদের জন্য আগাম সুখ-শান্তির কথা!
স্বামীর মৃত্যুর পর ফাতেমা বেগম চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। কী করবেন তিনি কিছুই ভেবে পেলেন না। অবশেষে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিরুপায় হয়ে অন্যের বাড়ীতে ঝি এর কাজ নিলেন।
অভাবের সংসার। ফাতেমা বেগম সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। মাঝে মাঝে কান্ত হয়ে পড়েন। ঝিয়ের কাজ করতে গিয়ে নানা লোকের নানান কথা শুনেন। কেউ আবার গালিগালাজও করে। ফাতেমা বেগম নীরবে সবকিছু সহ্য করেন আর সবার অলক্ষ্যে আঁচলে মুখ মুছেন।
ছয় বছর বয়স হওয়ার পর আব্দুল খালেককে স্কুলে ভর্তি করে দেন ফাতেমা বেগম। বিভিন্নভাবে কষ্ট পেলেও সন্তান যখন স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে সকল দুঃখ ভুলে যান তিনি। সেই সাথে নামাজের পর জায়নামাজে বসে শুধু আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন-- ওগো দয়ালু আল্লাহ! ওগো করুণার আধার! তুমি আমার আব্দুল খালেককে কবুল করে নাও। তার ভবিষ্যতকে তুমি উজ্জ্বল করে দাও। তাকে হেফাজত করো সকল প্রকার বিপদাপদ থেকে।
সময় চলতে থাকে আপন গতিতে। দেখতে দেখতে আব্দুল খালেক বড় হয়। একসময় এস,এস, সি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার তারিখ ঘনিয়ে আসে। আব্দুল খালেক ভাবনায় পড়ে যায়। সে চিন্তা করতে থাকে, মাকে স্কুলের বেতন পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হয়। এখন রেজিস্ট্রেশনের এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি?
একদিন স্কুলের প্রধান শিক আব্দুল খালেককে ডেকে বলেন, বাবা! এস, এস, সি পরীক্ষা তো অতি সন্নিকটে। পরীক্ষার ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশন করতে বারশ টাকার প্রয়োজন হবে। যেহেতু রেজিস্ট্রেশন করার সময় আর মাত্র দু'দিন বাকী আছে তাই যেভাবেই হোক আগামী দু'দিনের মধ্যেই টাকাটা যোগাড় করে নিয়ে এসো। কেমন!
জবাবে আব্দুল খালেক বলে, স্যার! আমার বোধ হয় এ বছর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। কারণ, আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে এ পর্যন্ত আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। এখন যদি মাকে এত টাকার কথা বলি তাহলে যত কষ্টই হোকনা কেন টাকা তিনি জোগাড় করবেন। কিন্তু আমি সন্তান হয়ে তার এ কষ্ট সহ্য করতে পারব না। এ বলে সে মন খারাপ করে বাড়ি চলে গেল।
বাড়িতে যাওয়ার পর ছেলের মলিন চেহারা দেখে ফাতেমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, বাবা! কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন আনমনা দেখাচ্ছে কেন? কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি তো? আব্দুল খালেক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফাতেমা বেগম নাছোড়বান্দা। অবশেষে আব্দুল খালেক মায়ের কাছে সব কিছু খুলে বলে। মা তখন মুচকি হেসে বললেন, বাবা! চিন্তা করো না। এস, এস, সি পরীক্ষার সময় তোমার যে বেশি টাকার প্রয়োজন হবে তা আমি আগেই জানি। তুমি শুনে খুশি হবে যে, দু টাকা, চার টাকা করে জমাতে জমাতে গত কয়েকদিন আগে এক হাজার দুইশ টাকা পূর্ণ হয়েছে। অতএব মন খারাপ করার কিছুই নেই। এ বলে ফাতেমা বেগম ঘর থেকে টাকার বাণ্ডিলটি এনে ছেলের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই নাও বাবা! এখনই স্কুলে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে এসো।
আব্দুল খালেক যথাসময়ে এস, এস, সি পরীক্ষা দেয়। এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সে । সন্তানের এই সফলতায় ফাতেমা বেগম যার পর নাই খুশি হন। তাই তিনি আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করে বলেন, হে আল্লাহ! আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এজন্য তোমার দরবারে জানাই লাখো-কোটি শোকর।
মায়ের অকান্ত পরিশ্রমের পয়সায় আব্দুল খালেক এম, এ, পাস করে। এখন সে পূর্ণ যুবক। বয়স পঁচিশ বছর। ওর আচার-আচরণ ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে হাইস্কুলের হেড মাস্টার ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। একদিন তিনি আব্দুল খালেককে কাছে ডাকলেন। তারপর বড়ই মমতার সুরে বললেন, বাবা আব্দুল খালেক! আমার বাড়িতে একটি প্রাইমারী স্কুল আছে। তুমি ইচ্ছে করলে প্রধান শিকের দায়িত্ব নিয়ে সেখানে চাকরি করতে পার। আর হ্যাঁ, আরেকটি কথা! আমার একটি মেয়ে আছে। সে আমার একমাত্র মেয়ে। তোমার পছন্দ হলে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে তাকে গ্রহণ করতে পার।
সব শুনে আব্দুল খালেক বলল, স্যার! এখন আমি কিছুই বলতে পারছি না। মায়ের সাথে আলাপ-আলোচনা করে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাব।
স্যার বললেন, ঠিক আছে। তাই করো।
আব্দুল খালেক বাড়িতে এসে মাকে স্যারের দেওয়া প্রস্তাব শোনাল। সব শুনে মা বললেন, স্যার তোমাকে চাকরি দিবে শোনে খুশি হলাম। আমিও তেমনটাই চেয়েছিলাম। সর্বদা আমি কায়োমনোবাক্যে পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করতাম, লেখাপড়া শেষ করার পর তোমার যেন ভালো একটা চাকরি হয়। তোমাকে বেকার হয়ে বসে থাকতে না হয়। আল্লাহ তাআলা আমার দোয়া কবুল করেছেন। কিন্তু স্যারের মেয়েকে বিবাহ করাটা কি তোমার ঠিক হবে? কারণ, সে তো আধুনিক কালের ফ্যাশনপ্রিয় আলট্রা মডার্ন মেয়ে! সে কি আমাকে মেনে নিবে?
আব্দুল খালেক বলল, মা! তুমি আমাকে এত কষ্ট করে মানুষ করেছ। এখন কি তুমি মনে করো যে তোমার পুত্রবধূ তোমাকে মেনে নিবে না! তোমার খেদমত করবে না! তোমার কথা শুনবে না?
ছেলের অমন কথা শুনে মা রাজী হয়ে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে বাবা, তুমি ভালো মনে করলে এই মেয়েকে বউমা করে ঘরে তুলতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
কিছুদিন পর আব্দুল খালেক চাকুরীতে যোগ দিল। স্যারের মেয়েকে বিয়ে করল। তারপর নববধূকে নিয়ে বাড়ী এল। এবং মায়ের কাছে নিয়ে মাকে দেখিয়ে বলল, ইনি আমার মা! যিনি গোটা জীবন আমার পিছনে ব্যয় করেছেন। সীমাহীন কষ্ট করে মানুষ করেছেন। আমার এই মমতাময়ী মায়ের ত্যাগের বিনিময়েই আমি তোমাদের স্কুলের প্রধান শিকের পদ অলঙ্কৃত করতে পেরেছি। পেরেছি তোমার মতো মেয়েকে বিয়ে করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে। তাই আমার এই মায়ের সাথে কখনোই তুমি অসদাচরণ করবে না। সবসময় তার খেদমত করবে। তিনি যখন যা করতে বলবেন তাই তুমি করবে। সুখে দুঃখে সর্বদা তুমি তার সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকবে। যাতে তিনি অতীত জীবনের সমস্ত কষ্ট ভুলে যান।
আব্দুল খালেকের স্ত্রীর নাম মুক্তা। সে ভেবেছিল, মুক্তা এখন এমন একটি কথা বলবে যদ্বারা সে এবং তার মা দারুণ খুশি হবে। কিন্তু হায়! সে এমন জবাব দিল, যাতে খুশি হওয়া তো দূরের কথা, উভয়ের মন ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল।
মুক্তা বলল, আমি এখানে তোমার মায়ের গোলামী করতে আসিনি যে, তার ভালো মন্দ আমাকে দেখতে হবে, তার খেদমত করতে হবে!
মুক্তার কথা শুনে আব্দুল খালেক ধৈর্য না হারিয়ে মাকে সান্ত্বনা দিল। বলল, মা! তুমি কোনো চিন্তা করো না। দেখবে অল্পদিনের মধ্যে আমি ওকে ঠিক করে নিব। এ বলে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিছুদিনের মধ্যে আব্দুল খালেক মুক্তার প্রেমে পড়ে গেল। ওর রূপ সৌন্দর্যের ধাঁধায় সে এতটাই নিমজ্জিত হয়ে গেল যে, মায়ের কথা ভুলে গেল। যে আব্দুল খালেক এতদিন ছিল সৃষ্টিকর্তার গোলাম, সে এখন হয়ে গেল স্ত্রীর গোলাম!
মুক্তা যখন দেখল, আব্দুল খালেক তার পুরোপুরি বশীভূত হয়ে গেছে তখন একদিন সে সুযোগ করে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, হয় তুমি আমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, না হয় সরিয়ে দাও তোমার মাকে?
কেন কী হয়েছে? আব্দুল খালেকের প্রশ্ন।
কী হবে আর! তোমার মা আমাকে দু'চোখে দেখতে পারে না। অযথা গায়ে পড়ে আমার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। আমি ভালো খাই, ভালো পরি-- এটা তিনি মোটেও বরদাশ্ত করতে পারেন না!
একথা শুনে স্ত্রীর প্রেমে অন্ধ আব্দুল খালেক তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে এবং হাতে একটি লাঠি নিয়ে মায়ের সামনে গিয়ে বলে, বুড়ি! তোমাকে আজকে সাবধান করে দিলাম। যদি তুমি মুক্তার সাথে দ্বিতীয়বার এমন কোনো আচরণ করো তবে মনে রেখো এই লাঠি তোমার পিঠে ওঠবে!
ছেলের কথায় মা বাকরুদ্ধ হয়ে যায় এবং তার অজান্ততেই চোখের পানিতে বুক ভাসতে থাকে। আর হৃদয়পটে ভেসে ওঠে পিছনের সব দুঃখ-স্মৃতি। এভাবে বেশ কিছুণ অতিবাহিত হওয়ার পর এক সময় তিনি অচেতন হয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়েন।
হুঁশ ফিরে আসার পর তিনি অজু করে নামাজ আদায় করেন। তারপর দু'হাত উপরে তুলে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, হে মাবুদ! তুমি আমার আব্দুল খালেককে সঠিক বুঝ দান করো। তাকে সত্য মিথ্যা যাচাই করার তাওফীক দাও। আর তার স্ত্রীর গর্ভে একটি সন্তান দাও। যাতে সে বুঝতে পারে সন্তানের উপর পিতা-মাতার অবদান কতটুকু!
এরপর গত হয় বেশ কয়েকটি মাস। একদিন মুক্তা তার শ্বাশুড়ীর নামে স্বামীর কাছে আবারো নালিশ করে। এতে আব্দুল খালেকের রাগ চরমে ওঠে এবং এক পর্যায়ে সে মায়ের উপর হিংস্রহায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছেলের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ফাতেমা বেগম মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু আব্দুল খালেক ্যান্ত হয় না। সে উপর্যপরি মায়ের উপর আঘাত হানতেই থাকে। মা বলতে থাকে, বাবা! আমি তো আজ তোমার বউয়ের সাথে কোনো কথাই বলিনি। অথচ বউমা তোমার কাছে আমার নামে নালিশ দিল? শোনো বাবা! প্রয়োজনে আমি এ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাব, তবু তুমি আমাকে আর মারিও না। আমি তোমার আঘাত সহ্য করতে পারছি না। বাবা! আব্দুল খালেক! তুমি কি পিছনের সবকথা ভুলে গেলে যে, তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর একমাত্র তোমার সুখের কথা ভেবেই আমি অন্যত্র বিয়ে বসিনি! তোমার লেখাপড়ার খরচ যোগাতে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে কত লাঞ্চিত, অপমানিত ও নির্যাতিত হতে হয়েছে-- এসব কি সবই ভুলে গেলে তুমি?
কিন্তু না, আব্দুল খালেকের কানে মায়ের কোনো আবেদন-নিবেদন অনুনয়-বিনয় কিছুই প্রবেশ করছে না। লাঠির আঘাতে আঘাতে বৃদ্ধা মায়ের দুর্বল শরীরটাকে সে তবিত করেই চলছে। বৃদ্ধা মা এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তার এই নিষ্ঠুরতায় সেদিন হয়তো গাছ-পালা, তরুলতা, পশু-পাখি সবই নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল।
মায়ের দোয়া কবুল হয়। কয়েকদিন পর আল্লাহ পাক আব্দুল খালেককে দান করলেন একটি ফুটফুটে সন্তান।
একদিনের ঘটনা। স্কুলের কাজ সেরে বাসায় ফিরতে আব্দুল খালেকের বেশ দেরী হয়ে যায়। ঘরে ঢুকেই সে দেখে তার স্ত্রী তার নবজাতক সন্তানকে বুকে নিয়ে খেলা করছে।
এখনো ঘুমাওনি। আব্দুল খালেক প্রিয়তম স্ত্রী মুক্তাকে সম্বোধন করে বলে।
কিভাবে ঘুমাব! বাচ্চাকে নিয়ে শোয়ার পর এ পর্যন্ত সে কয়েকবার পেশাব করে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়। আমি প্রত্যেক বারই কাপড় পাল্টে দেই। অবশেষে আর কোনো শুকনো কাপড় না থাকায় তার নীচে আমার পরণের শাড়ীর আঁচলটা বিছিয়ে রাখি। কিন্তু আজ যে ওর কী হলো! তুমি আসার একটু আগে ঐ কাপড়টাকেও সে নষ্ট করে দেয়। তাই শেষ পর্যন্ত ওকে বুকে নিয়ে খেলা করতে থাকি। আর শোনো, ওর প্রতি আমার যে কী মায়া তা তুমি বুঝবে না! আমি ওকে গর্ভে ধারণ করেছি। তাই আমিই বুঝি ওর কত মূল্য! বুঝি ওর জন্য আমার প্রাণটা কেমন করে!! এ বলে মুক্তা স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
স্ত্রীর কথা শুনে আব্দুল খালেকের হৃদয় খুলে যায়। সে তার নিজের ভুল বুঝতে পারে। তাই দেরী না করে এক দৌড়ে সে মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর মাকে দরজা খোলার জন্য বলে।
আব্দুল খালেকের মা তখন জায়নামাজে বসে মুনাজাত করছিলেন। ছেলের কথা শুনে তিনি ভাবলেন, বউমা হয়তো আমার বিরুদ্ধে আজও কোনো অভিযোগ পেশ করেছে। তাই আব্দুল খালেক আমাকে মারতে এসেছে। একথা চিন্তা করে তিনি তাড়াতাড়ি মুনাজাত শেষ করে ভালো করে দরজার খিল লাগিয়ে দিলেন। তারপর বলতে লাগলেন, বাবা! তোমার বউয়ের সাথে আমার কোনো ঝগড়া হয়নি। আর সেদিন যে তুমি আমাকে মেরেছো সেই ব্যথা আজো যায়নি। আজকে যদি আবার আমাকে মারো তাহলে হয়তো আমি মরেই যাবো!
আব্দুল খালেক বলল, মাগো! দরজা খোলো। না হয় দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকব!
মা ভাবলেন, যদি ছেলের রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে, তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি সে দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকবে এবং আমাকে বেদম প্রহার করবে। তাই অধিক শাস্তির ভয়ে তিনি দরজা খুলে দিলেন।
দরজা খোলার সাথে সাথে আব্দুল খালেক মায়ের পায়ে পড়ে শিশু বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে এবং বড়ই অনুনয় বিনয়ের সাথে মায়ের কাছে মা চায়। আর বলে, মাগো! আমার স্ত্রী যদি মাত্র কয়েকদিনে সন্তানের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, পারে এত ভালোবাসতে, তাহলে তুমি তো আমার জন্য অনেক করেছো। আজীবন করেছো। তোমার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে তিলে তিলে আমাকে মানুষ করে তুলেছ। আমাকে মা করে দাও মা। আমি না বুঝে তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করেছি, মেরে রক্তাক্ত করেছি। আসলে আমি স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম!
বৃদ্ধ মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাবা! আমি জানতাম, একদিন তোমার ভুল ভাঙ্গবে। একদিন তুমি বুঝতে পারবে এবং আমার বুকে ফিরে আসবে। বাবা! তুমি হয়তো জানো না, আমি তোমার জন্য কত দোয়া করেছি। দোয়া করেছি, আল্লাহ পাক যেন তোমার ভুল ভেঙ্গে দেন। বিশ্বাস করো, তুমি আমাকে এত কষ্ট দেওয়ার পরও আমি তোমার জন্য বদদোয়া করতে পারেনি। আর শোনো বাবা! সন্তান যদি কোনো ভুল করার পর মা বাবার কাছে মা চায়, তাহলে আমার মনে হয়, পৃথিবীতে এমন কোনো মা-বাবা নেই যারা তাকে মা করবে না। যাও আমিও তোমাকে মা করে দিলাম।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! সন্তানের উপর মা-বাবার অবদান সত্যিই অতুলনীয়। তাই আসুন আমরা মা-বাবার অবদানকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করি। প্রাণভরে তাদের খেদমত করি। তাদের প্রয়োজনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেই। আর কোনো সময় কোনো কথা বা কাজের দ্বারা তাদের মনে কষ্ট না দেই। হ্যাঁ, যদি কখনো ভুলক্রমে কিংবা অনিচ্ছায় তাদের মনে কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলি তাহলে সাথে সাথে মা চেয়ে নিই। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন।
[বি : দ্র : এরূপ আরো কয়েকটি ঘটনার জন্য দেখুন হৃদয় গলে সিরিজ, -২ : ৭০ # ৭ : ৩৩ # ১১ : ৫২ # ১২ : ১৮ # ১৩ : ৫৩ # ১৯ : ৪২,৪৮

Post a Comment

0 Comments